ড. মো: গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী১, ড. মো: মিয়ারুদ্দীন২
আম আমাদের দেশে অন্যতম একটি জনপ্রিয় ফল। স্বাদে, গন্ধে এবং ফলের রং এটিকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে তেমনি পুষ্টি সমৃদ্ধ ফল হিসেবে পরিগনিত হয়েছে। আম পুষ্টিগুনে ভরপুর বলে সকলেই এটি বিভিন্নভাবে খেতে পছন্দ করে। ভিটামিন ’এ’, ’সি’, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, জিংক, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি অধিক পরিমাণে ফলটিতে বিদ্যমান রয়েছে। আমাদের দেশে আমের সংগ্রহোত্তর অপচয় ২৫-৪০% বা অনেক সময় উৎপাদন বেশি হওয়ায় সঠিক পরিচর্যা, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের অভাবে এর অপচয় অধিক পরিমাণ হয়ে থাকে। কিন্তু আমের মূল্য সংযোজনের (ঠধষঁব ধফফরঃরড়হ) মাধ্যমে ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে সারা বছর বহুমুখী খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে স্বল্প খরচ ও সহজ প্রযুক্তি প্রয়োগ এর মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বছর ব্যাপী ব্যবহার করা যাবে। বাংলাদেশে আম উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলোর মধ্যে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মেহেরপুর, যশোর, সাতক্ষীরা, টাংগাইল, গাজীপুর, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল অন্যতম।
উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে প্রায়ই প্রতিবছর ঝড়, শিলা বৃষ্টি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগে প্রচুর পরিমাণে আম ঝরে পড়ে। আম কৃষক বা ব্যবসায়ী ঝড়ে পড়া কাঁচা আম খুব অল্প দামে বাজারে বিক্রি করে। এতে প্রথমে বেশি মূল্য পেলেও পরবর্তীতে খুব অল্প দামে কাঁচা আম বাজারে বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। আম চাষী কোন পরিচর্যা ছাড়াই হিপ বা স্তুপ করে আম মাটিতে এক জায়গায় রাখে। এতে আমের কষ, ধুলা-বালি বা খালি হাতের সংস্পর্শে বিভিন্ন জীবানুর আক্রমণে আম দ্রæত পচঁতে শুরু করে। কিন্তু আমের সংগ্রহোত্তর পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সংরক্ষণ সময় বৃদ্ধিসহ প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন খাবারের সাথে ব্যবহার করা যাবে বা বহুবিধ খাদ্য সামগ্রী তৈরি করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে কৃষি জাত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান যেমন- প্রাণ, স্কয়ার, আহমেদ প্রডাক্টস্, রাজশাহী ম্যাংগো প্রডাক্টস্ ও অন্যান্য ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান স্বল্প পরিমানে আমের পণ্য দেশে ও বিদেশে বাজারজাত করে থাকে। উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে ম্যাংগো বার, ম্যাংগো জুস অন্যতম। কিন্তু আমাদের দেশে যে পরিমান আম উৎপন্ন হয়ে থাকে সে তুলনায় আম হতে উৎপাদিত পণ্য ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান খুবই নগন্য। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ও এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, চীন, জাপান, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়ায় আমের বিভিন্ন রকমের পণ্য যেমন-আমের জুস, নেকটার, ড্রাইড ম্যাংগো প্রডাক্টস্, অসমোটিক ডিহাইড্রেটেড পণ্য, কনসেনট্রেটেড ম্যাংগো প্রডাক্টস্, আমের পাল্প, ম্যাংগো বার ইত্যাদি বাজারে দেখা যায়, যা ঐসব দেশেই স্থানীয়ভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়ে থাকে।
দেশের আপামর জনগোষ্টীর পুষ্টির চাহিদা বিবেচনা করলে আম প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্য তৈরির মাধ্যমে পুষ্টির চাহিদা কিছুটা হলেও পূরণ করতে সক্ষম হবে। এছাড়া আমাদের দেশের বড় বড় সুপারশপ ও বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান বিদেশ হতে প্রতি বছর বিভিন্ন আমের পণ্য আমদানি করে এবং তা অধিক মূল্যে আমরা ক্রয় করে থাকি। এক্ষেত্রে দেশের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরিকৃত স্বল্প খরচে প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কার্যক্রম বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইত্যেমধ্যে ষ্টীপিং পদ্ধতিতে ৮-১০ মাস কাঁচা আম সংরক্ষণ, গুণগত মানসম্পন্ন আমচুর প্রক্রিয়াজাতকরণ, ম্যাংগো বার, আমসত্ত¡, আমের অসমোটিক ডিহাইড্রেটেড পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, কাঁচা আমের জুস, কাঁচা আমের পাউডার, স্বল্প খরচে আমের আচার, চাটনি ইত্যাদি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনীর মাধ্যমে সম্প্রসারণের কার্যক্রম কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাঁচা আম সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শীর্ষক কর্মসূচির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও যেকোন উদ্যোক্তা প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করে কাঁচা আম প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে সক্ষম হবেন। এতে করে এই কৃষি পণ্যের নতুন বাজার তৈরির পাশাপাশি এগ্রো প্রসেসিং শিল্পে বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে এবং অধিক পরিমাণে কৃষি পণ্য হিসেবে কাঁচা আমের ব্যবহার বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। ফলে আমচাষী, আম বিক্রেতা ও বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে লাভবান হবে। সর্বোপরি, নিজেদের পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা মেটানো যাবে এবং দেশ আর্থিকভাবে লাভবান হবে। য়
১উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কর্মসূচী পরিচালক (কাচাঁ আম সংগ্রহোত্তর প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ কর্মসূচী, ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বিএআরআই, গাজীপুর-১৭০১। মোবা: ০১৭১২২৭১১৬৩, ই-মেইল : ferdous613@gmail.com